বাংলাদেশের প্রচলিত বিয়ের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি

বিয়ে মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এই অধ্যায় কে কেন্দ্র করে এক বিরাট আলোচনা হয়ে থাকে আমাদের দেশে। প্রথম আলোচনা শুরু হয় পরিবার থেকে। সাধারণত পিতা মাতা তাদের সন্তান দের মধ্যে মেয়ে বা কন্যা সন্তানের বিয়ে নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বিয়ে দিয়ে চান অধিকাংশ বাবা মা। কারণ কন্যা সন্তানকে বিয়ে যতটা কঠিন ঠিক ততটাই সহজ হল ছেলে সন্তানকে বিয়ে দেওয়া।

মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বাবা মা খুব সচেতন থাকেন। ভাল ছেলে খুঁজতে থাকেন আর নিজের আত্বীয় স্বজনদেরকে জানাতে থাকেন যাতে তারা ভাল ছেলে খোঁজ পেলে তাদের জানায়। অন্য দিকে আমাদের দেশের অধিকাংশ স্বল্পশিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে হয় বাবা-মার পছন্দ অনুযায়ী। এজন্য তাদের বিয়ে দ্রুত হয়ে থাকে। তবে উচ্চশিক্ষিতদের ক্ষেত্রে যারা বিয়ে করার ব্যপারে সহযোগিতা করে অর্থাৎ ঘটক সহ বিভিন্ন লোকের সাহায্য সাধারণত নিতে হয়। অনেকে আবার বাবা মাকে বুঝিয়ে বিয়ে করে নেন। কেউ কেউ নিজ ইচ্ছাতেও বিয়ে করে ফেলেন। ছেলেদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি প্রায় একই রকম।

বিয়ের প্রচলিত নিয়ম

বিয়ের জন্য অভিভাবকরা বিশেষ করে বাবা মা খুব চিন্তিত থাকেন। বেশি চিন্তা করে থাকেন মেয়ের বিয়ে নিয়ে আর ভাল পাত্র পেলেই আর দেরি করতে চাননা। নিজের আত্বীয় স্বজন বা ঘটকের মাধ্যমে ভাল ছেলে পেলে প্রথমে ঐ পাত্রকে গোপনে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পাত্র বা ছেলের কর্ম প্রতিষ্ঠান, তার বর্তমান আবাসস্থল, স্থায়ী আবাস, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি প্রথমে জেনে নেন। এর পর পাত্র বা ছেলের আত্বীয় বা বন্ধুদের মাধ্যমে তার অন্যান্য অভ্যাস, চাল-চলন লাইফ-স্টাইল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। ছেলের বা পাত্র পক্ষের শারীরিক গঠন, উচ্চতা, রুচি বোধ ইত্যাদি যখন ঐ মেয়ে তথা পাত্রী পক্ষের পছন্দের সাথে মিলে যায় তখন তারা নিজের ঘনিষ্ঠজনেরা পরামর্শ শুরু করে নিজের মেয়ে তথা পাত্রী এর সাথে মানাবে কিনা চিন্তা ভাবনা করে। এরপর নিজেরা একমত হলে ঐ পাত্রকে তাদের বাড়িতে বা পছন্দ মত কোন জায়গায় দাওয়াত দেয় পাত্রীকে দেখার জন্য। পাত্রীকে দেখার সময় পাত্র সাধারণত তার ঘনিস্ট জনদেরকে সাথে নিয়ে যায়। নিজের পিতা মাতা, বন্ধু, বোন, ভাগ্নে, ভাইঝি ইত্যাদি। এসময় কনে এর পক্ষ ভাল খাবারের আয়োজন করে আর কৌশলে মেয়ের সুনাম করে থাকে্ন। মেয়ে তথা পাত্রীকে দেখার সময় তার হাত দেখা, হাঁটার, কথা বলার ধরণ, শারিরীক গঠন, মাথার চুল ইত্যাদি অভিভাবকেরা ভাল ভাবে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এর পর কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়ে। আর এসময়  ছেলে মেয়ের পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলি জেনে নেন।

উভয়ের পছন্দ হলে ছেলের পক্ষ থেকে সাধারণত মেয়েকে উপহার দিয়ে থাকেন। এই উপহার বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

উভয়ের অভিভাবক তথা বাবা মা তাদের কাছ থেকে তাদের মতামত নিয়ে বিয়ের জন্য দিন তারিখ ঠিক করে নেন।

নির্ধারিত সময়ে সাধারণত পাত্র ও পাত্রী উভয় পক্ষের আত্বীয় স্বজনের উপুস্থিতিতে সুস্বাদু ও আকর্ষনীয় ভোজনের আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এসময় অতিথিরা বিভিন্ন উপহার নিয়ে নব-দম্পত্তিকে দোয়া করে থাকেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানের আরও একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হল বিয়ে সরকারি আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করা হয়। এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের পাশাপাশি স্টাম্পে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়।

ধর্মীয় রীতির প্রভাব

আমাদের দেশের বিয়েতে ধর্মের প্রভাব লক্ষণীয়।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর মুসলিম এই চার ধর্মের লোকই আমাদের দেশে বেশি রয়েছে। তবে সবচাইতে বেশি লক্ষ্য করা যায় হিন্দু এবং মুসলিমদের রীতি।

হিন্দুদের বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতি মেনে চলা হয়, যদিও বর্তমানে অতীতের চেয়ে নীতি তুলনামূলক শিথিল। আর মুসলিমদের বিয়ে ছিমছাম ভাবে হয়। পাত্র ও পাত্রীর উভয় পক্ষের দুই জন সাক্ষী উপুস্থিত থাকলে সহজে বিয়ের কাজটা সারা যায়।

ইসলাম ধর্মমতে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ যারা বিয়ে করে স্ত্রীকে ভরণপোষণ করতে পারবে তথা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং শারীরিকভাবে সুস্থ অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম সে বিয়ে করতে পারবে। এখানে বয়স কোন ব্যাপার নয়, ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে।

কালিমা পড়ে মহান আল্লাহ স্মরণ করে মসজিদ বা কনে পক্ষের বাড়িতে বা কোন নির্দিস্ট জায়গায় এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে। রেজিস্ট্রি বা লিখিত দলীল কোন জরুরী বিষয় নয়।কিন্তু বর্তমানে সরকারি এসব নিয়ম খুব গুরুত্বের সাথে মানা হচ্ছে। বিয়ের মহরনা কত হবে তার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। এ বিষয়টি নির্ভর করে পাত্রের আর্থিক যোগ্যতা এর উপর। তবে এই মহরের অর্থ নগদ আদায় করতে হবে। অথবা জীবনের কোন এক সময় অবশ্যই আদায় করে নিতে হবে। ইহা সমর্পণ স্ত্রীর হক।

বিয়ে পরবর্তী ভোজ তথা ওলিমা আদায় করা পাত্র পক্ষের দায়িত্ব। ওলিমা আদায় করতে হবে কিন্তু খুব বেশি খরচ করা বা কমা করা ইত্যাদি পাত্র পক্ষের ব্যপার। তবে ইসলাম কম খরচ করাকে প্রাধান্য দেয়।

বিয়ের পর স্ত্রীর সমর্পণ দায়িত্ব স্বামীর উপর বর্তাবে আর এভাবে শুরু হল পথ চলা।

বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র পাত্রী নির্বাচনের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যপক ব্যবহারের প্রভাব বিয়ের মধ্যেও পড়েছে। পাত্র- পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে প্রযুক্তি। ইন্টারনেটের সর্বচ্চ ব্যবহার এর ফলে মানুষ নিজের অজান্তেই প্রযুক্তি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর অন্য দিকে অভিভাবকদের ব্যস্ততা, ঘটিক পেশার লোকদের প্রতি আস্থাহীনতা ইত্যাদি কারনে আজ কাল নিজের বিয়ের জন্য নিজেকেই পাত্র পাত্রী খুঁজে নিতে হচ্ছে। আর এই চাহিদার ফলে তৈরি হচ্ছে অনলাইন মেট্রিমনি সাইট (যেমন biyeta.com)। এই সাইট গুলোতে নিজের বায়ো-ডাটা ও নিজের পছন্দের কথা উল্লেখ করে খুব সহজে ও স্বল্প ব্যায়ে খুঁজে নেওয়া সম্ভব নিজের পছন্দের পাত্র বা পাত্রী।

পরিশেষে সবাইকে বিয়ে করে সুন্দর জীবন গড়ার আহবান জানাচ্ছি। প্রচলিত নিয়ম ও ধর্মীয় নিয়ম নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আপনাকে বিয়ে করতে হবে। তাই নিজেকে গড়ে তুলুন আর প্রস্তুত করে তুলুন নিজেকে বিয়ের জন্য।  ধন্যবাদ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.