ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে যে ৯টি বিষয় জানা অত্যন্ত জরুরী

‘বিয়ে’ শব্দটি পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সকল প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর জীবনে বহু আকাঙ্ক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সকলের জীবনেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন সে একজন জীবনসঙ্গীর সাথে নতুন জীবনের পথে পা বাড়ায়।

তবে বিয়ের পূর্বে রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর তা হচ্ছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ও কনে দেখার পর্ব। ইসলাম একটি পূর্ণ জীবনবিধান, তাই বিয়ের পূর্বে বিয়ের প্রস্তাবনা ও কনে দেওয়ার বিষয়েও রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা। তাই সালাত-সিয়াম সহ জীবনের অন্যান্য ব্যাপারের মত বিয়ের প্রস্তাব ও কনে দেখার ক্ষেত্রেও শরীয়তের নির্দেশনা মেনে চলা এক ধরনের আমল ও ইবাদত। কিন্তু ইসলামের সঠিক দিক নির্দেশনা না জানায় আমরা প্রায়ই বিয়ের প্রস্তাব ও কনে দেখার ক্ষেত্রে ইসলাম পরিপন্থী কাজ করে ফেলি।

বিয়ের আগে যেহেতু আসে বিয়ের প্রস্তাব ও কনে দেখার মত ব্যাপার, তাই বিয়ের আগেই জেনে নেওয়া দরকার- ইসলাম আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ও কনে দেখার ক্ষেত্রে কী নির্দেশনা দিচ্ছে।


ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে বলতে কী বোঝায়

বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং আদর্শ পরিবার ও নিরাপদ সমাজ গড়ে ওঠে। বিয়ে শুধু নারী-পুরুষের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক নয়, সুস্থ্য ও স্বাভাবিক সমাজ গঠনের মূল হাতিয়ার হচ্ছে বিয়ে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা, তা চক্ষুকে অবনত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে এর সামর্থ্য রাখে না, তার কর্তব্য রোযা রাখা। কেননা তা যৌন উত্তেজনার প্রশমন ঘটায়।” (বুখারী : ৫০৬৬; মুসলিম : ৩৪৬৪)

এ জন্যই আলিমগণ বলেছেন, সাগ্রহে বিবাহ করা নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।

বিয়ের প্রস্তাব ও তার নিয়ম

বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ও পাত্র-পাত্রীর মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছু ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ রয়েছে, যা উভয় পক্ষেরই বিবেচনায় নিতে হবে। যখন কেউ কোন নারীকে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়, তখন তার উচিত ওই মেয়ের অভিভাবকের মাধ্যমে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করা।

১.শরীয়তে বিয়ের প্রস্তাব বলতে কী বোঝায়

বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশনা হচ্ছে, এমন ব্যাক্তির পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, যার প্রস্তাব গৃহীত হতে পারে। এটি বিবাহ পর্ব সূচনাকারীদের প্রাথমিক চুক্তি। এটি বিবাহের ওয়াদা এবং বিবাহের প্রথম পদক্ষেপ।

২.ইস্তিখারা করা

সকল নর-নারীর জীবনে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই যখন তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবেন, তাদের জন্য কর্তব্য হলো ইস্তিখারা তথা আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি। কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ, এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উল্লেখ করবেন) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, জীবিকা ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অতঃপর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন।”  (বুখারী : ১১৬৬; আবূ দাউদ : ১৫৪০)

৩.নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করা

বিয়েতে সম্মতি দেওয়ার পূর্বে বিয়ে ও সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে অভিজ্ঞ কারও সাথে যোগাযোগ ও পরামর্শ করা উচিত, যিনি পাত্র বা পাত্রীর পরিবার সম্পর্কে ভালভাবে জানেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে অধিক পরিমাণে পরামর্শ করতেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে অন্য কাউকে আপন সাথীদের সঙ্গে বেশি পরামর্শ করতে দেখি নি।”(তিরমিযী : ১৭১৪; বাইহাকী : ১৯২৮০)

হাসান বসরী (রঃ) বলেন, “মানুষের মধ্যে তিন ধরনের ব্যক্তিত্ব রয়েছেঃ কিছু ব্যক্তি পূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, কিছু ব্যক্তি অর্ধেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং কিছু ব্যক্তি একেবারে ব্যক্তিত্বহীন। পূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি সেই, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং পরামর্শও করেন। অর্ধেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেই, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তবে পরামর্শ করেন না। আর ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তি তিনিই, যিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না আবার কারো সঙ্গে পরামর্শও করেন না।” (শিহাবুদ্দীন আবশীহী, আল-মুসতাতরিফ ফী কুল্লি মুসতাযরিফ : ১/১৬৬)

তবে যার সাথে পরামর্শ করবেন, এ ক্ষেত্রে তার কর্তব্য হচ্ছে বিশ্বস্ততা রক্ষা করা। তিনি যেমনি কারও কোন দোষ লুকাবেন না, তেমনি আসলে নেই, এমন কোনো দোষের কথাও বানিয়ে বলবেন না। আর অবশ্যই এ পরামর্শের কথা কাউকে বলবেন না।

৪.পাত্রী দেখা

কেউ যখন কোন একজন নারীকে বিয়ে করতে চায়, তখন তার ওই নারীর সাথে দেখা করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা ইসলামে রয়েছে।  মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নির্দেশনা থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণ পাওয়া যায়।


মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,

“তোমাদের কেউ যখন নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, অতপর তার পক্ষে যদি ওই নারীর এতটুকু সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হয়, যা তাকে মুগ্ধ করে এবং মেয়েটিকে (বিয়ে করতে) উদ্বুদ্ধ করে, সে যেন তা দেখে নেয়।” (বাইহাকী, সুনান কুবরা : ১৩৮৬৯)

অপর এক হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

“আমি মহানবী (সাঃ) এর কাছে ছিলাম। এমতাবস্থায় তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে জানাল যে, সে একজন আনসারী মেয়েকে বিয়ে করেছে। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি তাকে দেখেছো?’ সে বললো, না। তিনি বললেন, যাও, তুমি গিয়ে তাকে দেখে নাও। কারণ আনসারীদের চোখে (সমস্যা) কিছু একটা রয়েছে।” (মুসলিম : ৩৫৫0)

৫.বিয়েতে পাত্রীর অনুমতি নেওয়া

বিয়েতে একজন নারীর অনুমতী নেওয়া খুবই জরুরী। বিয়ের সিদ্ধান্তে তার মতামত নেওয়া একজন নারীর অধিকার এবং তার পিতা বা অভিভাকদের তার ইচ্ছার বাইরে যাওয়া অনুচিত।

মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, “একজন নারী যার পূর্বে বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার পিতা বা অভিভাবকের তুলনায় বেশি এবং একজন কুমারী মেয়ের বিয়েতে অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক, (তবে) নীরবতাই তার সম্মতি।” (বুখারী ও মুসলিম)

৬.বর-কনের পারস্পরিক যোগাযোগ বা বাইরে ঘুরতে যাওয়া

বিয়ের আগে একজন নারী বিয়ের প্রস্তাবদানকারী পুরুষের সাথে মোবাইল, চিঠি বা ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারবেন, তবে তা শুধুমাত্র বিয়ের চুক্তি বা শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য এবং সে যোগাযোগ হতে হবে অবশ্যই ভাব ও আবেগবর্জিত পন্থায়। উল্লেখ্য, এ যোগাযোগ উভয়ের পিতা বা অভিভাবকের সম্মতিতেই হওয়া উচিত। তাছাড়া বিয়ের পূর্বে প্রস্তাবদানকারীর সাথে ঘুরতে বের হওয়া, সফরে যাওয়া বা নির্জনে অবস্থান করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। কেননা, বিয়ে না হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই পুরুষ তার কেউ নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হচ্ছে।

৭.একজনের সাথে বিয়ের কথা-বার্তা চলতে থাকাবস্থায় অন্য কারও প্রস্তাব না দেওয়া

কোন নারীর যখন অন্য কোথাও বিয়ের জন্য কথা-বার্তা চলছে বা যখন কোন নারীর অন্য কারও সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তখন সেই নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া শরীয়তে নিষিদ্ধ। তবে প্রথম প্রস্তাবদানকারী যদি অনুমতি দেয় বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়, তবে দ্বিতীয় কেউ সেই নারীকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিতে পারবে।

সহীহ মুসলিম অনুসারে মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, “একজন বিশ্বাসী অপর বিশ্বাসীর ভাই। তাই কোন কিছু কেনার সময় এক ভাইয়ের উপর আরেক ভাইয়ের অধিক দাম হাকানো বা এক ভাই যখন কোন নারীকে প্রস্তাব দেয়(বিয়ের) তখন অন্য ভাইয়ের তাকে প্রস্তাব দেওয়া(বিয়ের) নিষেধ, যদি না সে তাকে অনুমতি দেয়।”

বুখারী শরীফ অনুসারে মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, “একজন আরেকজনের বাগদত্তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে না, যতক্ষণ না সে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে অথবা তাকে অনুমতি দেয় (বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার)।”

৮.উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করা

উপযুক্ত পাত্রের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেলে তা নাকচ করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে মুহাম্মাদ (সাঃ) তাগিদ দিয়েছেন।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি এমন কেউ তোমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়, যার ধার্মিকতা ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। যদি তা না করো, তবে পৃথিবীতে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হবে।” (তিরমিযী: ১০৮৪)

মুহাম্মাদ (সাঃ) আরও বলেন, “তিনটি বিষয়ে দেরি করা উচিত নয়ঃ সালাত আদায়- যখন সালাতের সময় হয়ে যায়, কবর দেওয়া- যখন জানাযা হয়ে যায় এবং একজন নারীর বিয়ে- যখন সম মর্যাদা সম্পন্ন কোন পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব দেয়।” (আল তিরমিযী)

বিয়ে বিষয়ক আরও আর্টিকেল পড়তে ভিজিট করুনঃ বিয়েটা ব্লগ

শেয়ার করুন

7 thoughts on “ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে যে ৯টি বিষয় জানা অত্যন্ত জরুরী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.